1. rajubdnews@gmail.com : 24jibonnews : admin
বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:০২ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ:
নোয়াখালীতে অর্থনৈতিক অসমতা অবসান ও সুবিচার শীর্ষক নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ভিশনের উদ্যোগে কমিউনিটি নেতা ও যুব ফোরাম এবং স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সাথে ওরিয়েন্টেশন সভা অনুষ্ঠিত ঠাকুরগাঁওয়ে বালিয়াডাঙ্গীর রবিউল ১৬ বছর পর বাড়ী ফিরবেন ! নরসিংদীর বেলাব থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকের মরদেহ উদ্ধার ঝাউডাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় ঋত্বিকা নামে শিশুর মৃত্যু পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে ১০ ফিলিস্তিনি নিহত ইরানের হামাদান প্রদেশের কাবুদারাহাং শহরে সামরিক বিমান বিধ্বস্ত চরম আকার ধারণ করেছে শিল্পের গ্যাস সংকট ওষুধ শিল্পের ওপর নতুন করে আরোপিত কর প্রত্যাহার পাবনা জেলা জিয়া সাইবার ফোর্স এর ৩১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্নাঙ্গ কমিটি অনুমোদন

কাঠামোগত সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়

প্রতিনিধির নাম :
  • আপডেট এর সময় : শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭

বর্তমান লেখাটি কোনো ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে নয়। একটি প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নবতম আবিষ্কার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কোনো এক বা দুটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অধিকারী উঁচুদরের মানবসম্পদ সৃষ্টি যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সে প্রতিষ্ঠানটির নাম বিশ্ববিদ্যালয়। লেখাটি লিখতে বসে অনেক কথা মনে পড়ছে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কাঠামোগত দুর্বলতা সম্পর্কে। আমি এর আগেও এ বিষয়ে কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিজ্ঞান সম্মেলনে পঠিত ‘বিজ্ঞান শিক্ষা ও সমাজ প্রাসঙ্গিকতা’ প্রবন্ধে বিষয়টি নিয়ে সামান্য বিস্তারিত আলোচনা করে তখন এদেশের বিজ্ঞানীদের সমাজ বিচ্ছিন্নতার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছিলাম। ছাত্রাবস্থায়ই বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। আমি কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিলাম। আমার প্রয়াত শিক্ষক জিল্লুর রহিম বিষয়টিকে আমার কাছে আরো স্পষ্ট করে তোলেন। আমরা তাকে ‘বার্ট্রান্ড রাসেল’ আখ্যায় ভূষিত করেছিলাম। তিনি ক্লাসে কেমিস্ট্রি পড়ানোর সময় মাঝে মাঝে অদ্ভুত কথা বলতেন, সেগুলো আমাদের মগজে ঢুকত না। কিন্তু সেসব কথা আমাদের খুব আকর্ষণ করত। স্যারকে আমার একজন সামগ্রিকভাবে শিক্ষিত ব্যক্তি বলেই মনে হতো। যারা বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য বিদেশে যান, তাদের সম্পর্কে উনি একটি মজার গল্প বলেছিলেন। গল্পটি আমার মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। আমার মনে হয়, তার সব ছাত্রই গল্পটি শুনে থাকবেন। একজন বুড়ি চোখে ভালো দেখতে পান না। রাস্তায় লাইটপোস্টের নিচে কিছু খুঁজছিলেন। তা দেখে জনৈক পথিক ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী বুড়িমা, কী খুঁজছেন?

বুড়ি তোতলাতে তোতলাতে বললেন, আমার সুচ হারিয়ে গেছে, তা-ই খুঁজছি। ভদ্রলোক একটু এগিয়ে এসে বললেন, কোথায় হারিয়েছে দেখি? উত্তরে বুড়ি বললেন, এখানে নয়, বাড়িতে। ভদ্রলোক অবাক হয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে এখানে খুঁজছেন কেন? বুড়ি বললেন, কী করব বাবা বাড়িতে যে আলো নেই। আমাদের দেশে হারানো সুচ খোঁজার জন্য এদেশের বিদ্বৎসমাজ বিদেশে যান। কিন্তু তারা কী হারিয়েছেন, সেটাও তারা জানেন না। বিদেশের অতুজ্জ্বল আলোয় তাদের সুপারভাইজাররা যে সমস্যা ধরিয়ে দেন, সেই বিষয়ে বিশেষ বিশেষজ্ঞ হয়ে দেশে ফিরে এসে তারা গবেষণায় লিপ্ত হন। সে জ্ঞান এদেশে কতটা প্রাসঙ্গিক তা ভেবে দেখারও প্রয়োজনবোধ করেন না। বিদেশ থেকে যে জ্ঞান নিয়ে আসেন, তার বাইরে তারা সচরাচর পা রাখেন না। পাঠক ক্ষমা করবেন, এ গল্পের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সার্বিক চিত্র উঠে এসেছে, তা বলা বা লেখার জন্য আজ বসিনি। আজ আমি যে বিষয় নিয়ে কথা বলতে বসেছি তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় নামক উচ্চশিক্ষার উচ্চতম স্থান থেকে উচ্চতম ডিগ্রি নিয়ে যারা বেরিয়ে আসছেন, আমার প্রশ্ন তারা কি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে বেরিয়ে আসছেন, নাকি তারা খণ্ডিত জ্ঞান নিয়ে একজন খণ্ডিত মানুষ হিসেবে বেরিয়ে আসছেন? এ প্রশ্নটি আমার অনেক দিনের। উত্তরের আশায় সামান্য বইপত্রও ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। সেটা করতে গিয়ে দেখলাম, অনেক আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ভেবেছেন, লিখেছেন, সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ১৯৫৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক সি পি স্নো ‘দুই সংস্কৃতি’ নামক একটি প্রবন্ধ লিখে ইউরোপে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন।

কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের ইতিহাস সমিতিতে আধুনিক বিজ্ঞানের উৎপত্তি সম্পর্কে বক্তৃতা প্রদানকালে হারবার্ট বাটারফিল্ড বড়ই আশা ব্যক্ত করেছিলেন যে, সে বক্তৃতা যেমন ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিজ্ঞান সম্পর্কে সামান্য আগ্রহ সৃষ্টি করবে, তেমনি বিজ্ঞানীদের মধ্যেও ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য আগ্রহ বৃদ্ধি করবে। তার সেদিনের সে আশাবাদের মধ্যে যে মনোভাব বা সত্যটি প্রকাশ পায় তাহলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ বা বিভাগ থেকে যারা উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে পাস করে বেরিয়ে আসছেন, তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসী। একের সঙ্গে অন্যের কোনো যোগাযোগ নেই। সি পি স্নোর মতে, বিজ্ঞান, কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগ থেকে পাস করে যারা বের হন, তারা একে অপরের ভাষা বোঝেন না। তাদের পরস্পরের মধ্যে আটলান্টিক মহাসাগরের দূরত্ব। আমরা যদি আর একটু পেছনে যাই তাহলে দেখব অক্টোবর বিপ্লবের পর স্বয়ং লেনিন কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম শিক্ষাকমিসার (commissar, মন্ত্রী) আনাতোলি লুনাচারস্কি ১৯১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর বিদ্যালয়মুক্ত শিক্ষা কোর্স উদ্বোধনকালে শিক্ষকদের উদ্দেশে প্রদত্ত বক্তৃতায় অনুরূপ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি শিক্ষার বিশেষীকরণ এবং সাধারণ শিক্ষার মধ্যে একটা ভারসাম্য স্থাপনের ইচ্ছা ব্যক্ত করে বলেছিলেন যে, Furthermore we see that almost everywhere specialisation has been carried so far that it disfigures the image of man. পৃথিবীর সর্বত্র বিশেষীকরণ এতদূর পৌঁছেছে যে, তা মানুষের ভাবমূর্তিকেই বিকৃত করেছে।

জার্মানির মতো তুলনামূলকভাবে প্রগতিশীল দেশেও অনেকেই ভাবছে যে, specialisation cripples the real man. বিশেষীকরণ মানুষকে জ্ঞানের একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে বিশেষজ্ঞ করে তুললেও জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় তাকে বিশেষভাবে অজ্ঞ করে তোলে। বিষয়টি পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত সমাজ ও ইতিহাস বিজ্ঞানী বিনয় ঘোষেরও নজরে এসেছিল। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘বাংলার বিদ্বৎসমাজ’ নামে একটি বই এর প্রথম দুটি প্রবন্ধে তিনি রঙ্গরস মিশিয়ে এ বিষয়ে সূক্ষ্মতর বিচার-বিশ্লেষণ করেছিলেন। প্রথম প্রবন্ধ ‘বাংলার বিদ্বৎসমাজে’ তিনি মূলত বিদ্বৎসমাজ বা বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নিরূপণ করার চেষ্টা করেছেন। এ জন্য তিনি ব্যাপকভাবে সমাজবিজ্ঞানী কার্ল ম্যানহেইম ও রবার্টো মিচেল্সের রচনার ওপর নির্ভর করেছেন। আমি আজ যে কথা লেখার জন্য বসেছি, ১৯৭৩ সালে বিনয় ঘোষ চমৎকারভাবে সে কথাগুলোই বলে গেছেন। আজকের লেখায় আমিও ব্যাপকভাবে বিনয় ঘোষের লেখার উদ্ধৃতি উল্লেখ করব। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত ত্রুটি নিয়ে লিখতে বসেছি সেক্ষেত্রে ঘোষের মতো বুদ্ধিজীবী বা বিদ্বৎসমাজের সংজ্ঞা বিস্তারিতভাবে নিরূপণ করা দরকার আছে কিনা, বুঝতে পারছি না। তবে যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ই বিদ্বৎসমাজ তৈরির কারখানা হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে, সে জন্য সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও বিদ্বৎসমাজের একটা সংজ্ঞা উপস্থিত করা প্রয়োজন বলেই মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত সংকট সেখানকার শিক্ষকদের মধ্যেও সংক্রামিত হবে- সেটাই স্বাভাবিক। শেষ পর্যন্ত তা finished product হিসেবে যে সব ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার লেবেল এঁটে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে তাদেরও আক্রান্ত করে। তাই কারা বিদ্বৎসমাজভুক্ত সে সম্পর্কে দুচারটা কথা বলা দরকার। সামন্তবাদী অর্থনীতির পতন এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির উত্থানের যুগসন্ধিক্ষণটি মানব ইতিহাসের পালাবদলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়।

আজ যেসব সামাজিক প্রত্যয়গুলোকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে ধরে নিই, পাক-পুঁজিবাদী সমাজে তার অনেক কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না এবং যদি কখনো পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিলুপ্ত হয়, তখন আজকের স্বতঃসিদ্ধ অনেক কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না। সেই যুগসন্ধিক্ষণের আগে জাতি, জাতীয়তা ও জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব খুঁজতে যাওয়া যেমন বোকামি ছাড়া কিছু নয়, তেমনি সামন্ত যুগে শিক্ষাও পণ্য হয়ে ওঠেনি। সেযুগে রাজা-বাদশারা সোনাদানা কলসি ভর্তি ধনের মতো আগলে রাখলেও তা পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়নি। কিন্তু আজ সবাই স্বীকার করবেন, বর্তমান পুঁজিবাদের যুগে সবকিছুর সঙ্গে শিক্ষা বা বিদ্যাও পণ্যে পরিণত হয়েছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সেই পণ্যটি কেনার হিড়িক পড়ে গেছে। যে যত বেশি দামে সে পণ্যটি কিনতে পারবে, সমাজে তার জন্য তত বেশি উঁচু স্থানটি সুনির্দিষ্ট রয়েছে। শিক্ষা গ্রহণ করে যিনি বড় বড় ডিগ্রি লাগিয়ে নিতে পারেন নামের শেষে, তাকে সচরাচর ‘শিক্ষিত’ বলা হয়। কিন্তু শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী কি সমার্থক? প্রথম প্রবন্ধে বিনয় ঘোষ এ প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন। বিদ্বৎসমাজ সম্পর্কে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন সেগুলো পশ্চিম বাংলার বিদ্বৎসমাজকে সামনে রেখে। আজ থেকে ২৭ বছর আগে সেদিন তিনি যে বিদ্রুপাত্মক করুণ বাক্যগুলো ছুড়ে দিয়েছিলেন সে দেশের বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে, সেগুলো আজ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। বরং সে দিনের ওপার বাংলার বিদ্বৎসমাজের চেয়ে আজকের বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজের অবস্থা আরো করুণ। সামান্য একটু মানসম্পন্ন শিক্ষা কেনার জন্য লাখ লাখ শিক্ষার্থীর সে দেশে গমন কি সেটাই প্রমাণ করে না? বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার পীঠস্থানগুলোতে যদি তা কিনতে পাওয়া যেত, তাহলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার ছেলেমেয়েদের ভারতে পাঠাতেন না। তাই বলছিলাম বিনয় ঘোষের সেদিনের সে বিশ্লেষণ আজকের বাংলাদেশের জন্যও একইভাবে সত্য।

রবার্টো মিচেলের It would be wrong to define intellectuals in terms of academic examination কথার প্রতিধ্বনি করে বিনয় ঘোষ বলেন, ‘শিক্ষিত’ আর ‘বিদ্বৎজন’ এক নন। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম ডিগ্রিধারী যারা উচ্চশিক্ষিতের খাতায় নাম লেখান, তারা সবাই বুদ্ধিজীবী নন। তবে বুদ্ধিজীবী কারা? বিনয় ঘোষের মতে, ‘সমাজের হাটে যিনি নিজের মনন ও মানুষের মন নিয়ে কারবার করেন তিনিই বিদ্বৎজন এবং দেশের বিদ্বৎসমাজের একজন। তা যিনি করেন না তিনি বিদ্বান হতে পারেন কিন্তু বিদ্বৎসমাজের একজন বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য নন।’ অর্থাৎ সামন্ত যুগে অলস সম্পদ যেমন পুঁজি বলে বিবেচিত নয়, তেমনি আজকের পুঁজিবাদী সমাজে ‘শিক্ষা’ নামক পুঁজির অধিকারী ব্যক্তিটিও পুঁজিতে পরিণত হন। অচাঞ্চল্য নয়, সচলতাই হলো পুঁজির প্রধান চরিত্র। তেমনি ‘মহাবিদ্বান হয়ে কেউ যদি অগাধ জ্ঞানসমুদ্রে ডুব দিয়ে তলিয়ে থাকেন এবং কেবল ভুরভুরি কাটেন, যদি তাকে দেখা না যায়, তার চিন্তাভাবনার কথা জানা না যায়, তাহলে তিনি জ্ঞানতপস্বী ‘স্কলার’ হলেও, সামাজিক অর্থে বুদ্ধিজীবী নন’- বলেন বিনয় ঘোষ। তিনি আরো বলেন, ‘ধনবিজ্ঞানের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট কোনো ছাত্র যদি পরবর্তী জীবনে পাটের ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করেন, তাহলে সমাজের কাছে বিদ্বৎজন বলে গণ্য হবার যোগ্য নন।’ কার্ল ম্যানহেইমের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক সমাজে নানা গোষ্ঠীভুক্ত এমন কিছু লোক থাকেন, যাদের কাজ হলো সেই সমাজের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি রচনা এবং ব্যাখ্যা করা। যারা সমাজের এ জীবনদর্শন ব্যাখ্যা করেন, তারাই বিদ্বৎসমাজের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য। তারাই প্রকৃত বিদ্বৎজন-বুদ্ধিজীবী।’ অর্থাৎ একালের বুদ্ধিজীবীরা সামন্তযুগের রাজ-দরবারাশ্রিত পণ্ডিতদের মতো নন, একালের বুদ্ধিজীবীরা গতরখাটা সামাজিক কর্মী। এই সংজ্ঞানুসারে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার পাঁচেক বিদ্বান পণ্ডিতের ক’জন বিদ্বৎসমাজভুক্ত হতে পারেন? এ প্রশ্নের উত্তরের ভার আমি পাঠকসমাজের ওপর ছেড়ে দিলাম।

‘বাঙালি বিদ্বৎসমাজের সমস্যা’ নামক দ্বিতীয় প্রবন্ধে বিনয় ঘোষ বাংলা তথা ভারতের বিদ্বৎসমাজের সমস্যার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেন। আমার মনে হয় বিনয় ঘোষ ইচ্ছাকৃতভাবে সমাজের মূল কাঠামোর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে উপরি কাঠামোর কতিপয় দৃষ্টিকটু সত্যের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। তার সে Observation-গুলো ছিল খুবই interesting. তিনি বলেন, ‘যন্ত্রযুগের খণ্ডিত বিখণ্ডিত শ্রমের মতো শিক্ষা ও বিদ্যাবুদ্ধিও খণ্ডিত-বিখণ্ডিত হয়েছে এবং যন্ত্রের এক্সপার্ট ও টেকনিসিয়ানদের মতো বিদ্যারও এক্সপার্ট বেড়েছে। … বিদ্যার ও বিদ্বৎজনের এই যান্ত্রিকতা বা মেকানাইজেশন এবং অতিবিভাজ্যতা বা ডিপার্টমেন্টালাইজেশন, আধুনিক বিদ্বৎসমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা ও সঙ্কট।’ বাংলাদেশে অন্য সব সঙ্কটের মতো উচ্চশিক্ষা তথা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কটের মূলে রয়েছে এদেশের লুটপাটের অর্থনীতি ও রাজনীতি। বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজ সে লুটপাটের অর্থনীতি ও রাজনীতির বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ হয়েছেন বললে ভুল বলা হয়। তাঁরাও সে লুটপাটের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে অংশ নেয়ার জন্য কোমর বেঁধে দাঁড়িয়েছেন। সে ব্যক্তি অর্জিত বিদ্যার সামান্য পুঁজি নিয়ে দু’তিন-হাজারী মানবসরদারের গদিতে বসে আছেন, যাদের জ্ঞানার্জনের সমস্ত আগ্রহ স্বার্থবাদ ও সুবিধাবাদের অনলে ভস্মীভূত এবং যারা ইনস্টিটিউশনের বৃহৎ ছত্রছায়ায় নিশ্চিন্তে প্রতিষ্ঠিত, তারা কখনো তাদের ছাত্রদের চিন্তাশীল কৌতূহলী বা অনুসন্ধানী হবার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারেন না। এ সমস্যা কেবল বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সমস্যা নয়, ম্যানহেইমের মতে, ‘এ সমস্যা বর্তমান যুগের আন্তর্জাতিক ও আন্তঃসামাজিক সমস্যা।’

সি.পি. স্নোর প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর যে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চার বছর পর ১৯৬৩ সালে তিনি নতুন আর একটি প্রবন্ধ লেখেন। নতুন প্রবন্ধটিতে তিনি তার আগের বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা একটা নতুন যুগে প্রবেশ করেছি যখন বিজ্ঞান, ঐতিহ্য ও কলা বিদ্যার একত্র হবার কোনো বিকল্প নেই।’ তিনি একটি তৃতীয় সংস্কৃতির উত্থানের সম্ভাবনা লক্ষ করেন, যে সংস্কৃতির স্রোতে এসে মিশবে সামাজিক ইতিহাস বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, স্থাপত্যবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং ‘বর্তমান বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ওপর মানুষের প্রভাব’ নিয়ে অন্য যারা শ্রম-বিনিয়োগ করছেন- তাদের সবার কর্ম ও গবেষণার ফল। সেদিন হয়তো খুব দূরে নয়। তাই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তঃবিভাগীয় ও অন্তঃবিভাগীয় বিচ্ছিন্নতার দেয়ালগুলো এখনই ভেঙে ফেলার সময়।
লেখক : শিক্ষাবিদ

পোস্টটি আপনার স্যোশাল মিডিয়াতে শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© All rights reserved © জীবন নিউজ ২৪ ডট কম
Theme Customized BY LatestNews